প্রিন্ট এর তারিখঃ অগাস্ট ১২, ২০২৫, ৯:২০ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুলাই ৩০, ২০২৫, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ
আমরা প্রায়ই বিবাহের খুতবা শুনে থাকি, কিন্তু কি কখনো ভেবে দেখেছি—সেই খুতবায় আসলে কী বলা হয়?! বিবাহের খুতবায়, হামদ (আল্লাহর প্রশংসা) ও দরুদ পাঠের পর কোরআন মাজিদের যে তিনটি প্রসিদ্ধ আয়াত তিলাওয়াত করা হয়, বিস্ময়ের বিষয় হলো—এই তিনটি জায়গায় বিবাহের সরাসরি কোনো আলোচনা নেই। বরং তিনটি আয়াতে একটিমাত্র বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে—আর তা হলো তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহভীতি, আত্মসংযম ও দায়িত্ববোধ।
তাকওয়া এমন এক বিস্ময়কর আলো, যার ছায়ায় জীবনের বহু জটিলতা আপনাতেই উদ্ঘাটিত হয়ে যায়, পথ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আল্লাহ তাআলা যখন বিবাহের খুতবায় তাকওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন, তখন তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে—স্বামী-স্ত্রী তখনই একটি সুখী দাম্পত্য ও প্রশান্তিময় পরিবার গড়ে তুলতে পারবেন, যখন তারা উভয়ে তাকওয়ার অলংকারে বিভূষিত হবেন।
যখন তারা এই উপলব্ধি নিয়ে জীবন যাপন করবেন যে জীবনের প্রতিটি কাজে তাদের একদিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে, তখনই তাঁদের সম্পর্ক হবে সততা, বিশ্বস্ততা আর আস্থার ভিত্তিতে গড়া।
আল্লাহ তাআলা মানবসভ্যতার সূচনা করেছেন ‘স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন’ দিয়ে। এই সম্পর্কের লক্ষ্য কী? এর গভীরতা ও স্থায়িত্বের রহস্যই বা কী? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন—‘তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জীবনসঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করো; আর তিনি তোমাদের মাঝে স্থাপন করেছেন ভালোবাসা ও দয়া।’ (সুরা আর-রুম, আয়াত : ২১)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলো প্রশান্তির চাবিকাঠি। একটি ঘর, একটি পরিবার—তা কেবল দেয়াল, ছাদ আর আসবাবের সাজসজ্জা নয়; বরং তা এমন এক আশ্রয়স্থল, যেখানে একজন মানুষ তার জীবনসঙ্গীর মুখের দিকে চেয়ে চোখের ভাষায়, হৃদয়ের ছোঁয়ায়, মায়া-মমতা আর আস্থায় প্রশান্তির এমন অনুভব পায়, যা দুনিয়ার কোনো বিলাসিতা দিতে পারে না।
কিন্তু যদি সেই ঘরে শান্তি না থাকে তবে সেটি আর ঘর থাকে না, হয়ে ওঠে উদ্বিগ্নতার ঘেরা এক কষ্টকর আবাস, যেখানে মানুষ আর থাকতে চায় না। সে তখন ছুটে বেড়ায় হোটেল, পার্ক, বন্ধু, ক্লাব কিংবা বিভিন্ন বিনোদনের আড়ালে শান্তি খুঁজে, কিন্তু সেই শান্তি অধরাই থেকে যায়। কারণ, যে ঘরে শান্তি নেই—দুনিয়ার কোনো কোণাই তখন শান্তির জায়গা হয় না।
কোরআনের বর্ণনায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তারা (নারীরা) তোমাদের (পুরুষদের) জন্য পোশাকস্বরূপ, আর তোমরাও (পুরুষরা) তাদের (নারীদের) জন্য পোশাকস্বরূপ।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৭)
আল্লাহ তাআলা কোরআনের এ আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে এক অসাধারণ এবং গভীর অর্থবহ উপমার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এই সম্পর্ক পোশাকের মতো—পোশাকের আছে বহু গুণ। তা আমাদের লজ্জাস্থান ঢাকে, সম্মান রক্ষা করে, শরীরকে সুরক্ষা দেয়, জীবনের শোভা বাড়ায়, স্বাস্থ্য ও শালীনতা বজায় রাখে। তেমনই দাম্পত্য সম্পর্কও একে অপরের ত্রুটি ও দুর্বলতা আড়াল করার মাধ্যম, পরস্পরের সম্মান ও মর্যাদার রক্ষাকবচ, এবং জীবনের শান্তি ও সৌন্দর্যের উৎস।
তদ্রূপ একটি ভালো পোশাক আমাদের গ্রীষ্মের তাপ ও শীতের কাঁপুনিতে আশ্রয় দেয়, ঝড়বৃষ্টি ও ধুলোবালি থেকে রক্ষা করে, তেমনই একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী তার সঙ্গীর দুঃখে আশ্রয়, সুখে সহচর এবং বিপদে সাথী হয়ে ওঠেন। স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কও এমনই একটি আবরণ, যা পরস্পরের সম্মান, মর্যাদা ও মানসিক প্রশান্তির রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই আয়াত আরও এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—যেমন আমরা কোনো প্রিয় পোশাকে কাদা বা দাগ লাগলে সেটিকে তুচ্ছ মনে না করে পরম যত্নে পরিষ্কার করে নিই, ছিঁড়ে ফেলার মতো মূর্খতা করি না—তেমনই দাম্পত্য জীবনে যদি কখনো মতানৈক্য, ঝগড়া বা রাগ-অভিমান ঘটে, তবে তা ভাঙনের দিকে না ঠেলে বরং সুখ-শান্তি ও সহনশীলতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়া উচিত। সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে, সংরক্ষণ করে, পুনরুদ্ধার করতে পারাই হল প্রকৃত প্রজ্ঞা।
অভিযোগ ও সমাধান
এই প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরি, তা হলো—প্রায় প্রতিটি বৈবাহিক সম্পর্কেই এক দীর্ঘ অভিযোগের তালিকা স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের মনে লুকিয়ে থাকে। সামান্য কোনো সুযোগ পেলেই সেই সমস্ত জমে থাকা অভিযোগ ঝরে পড়ে। কখনো ধীরে, কখনো প্রচণ্ড বেগে। এসব অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত থাকে সম্পর্কে উষ্ণতা ও যত্নের ঘাটতি, পারস্পরিক দায়িত্বে অবহেলা, ঝগড়া-বিবাদ, গালিগালাজ, শারীরিক আঘাত, তিরস্কার, বসবাসের সমস্যা, শ্বশুরবাড়ি ও পিত্রালয়ের হস্তক্ষেপ, রূপ-রস, গুণাবলি ইত্যাদি নিয়ে অসন্তুষ্টি। অর্থাৎ এমন কোনো বিষয় বাদ যায় না—যেখানে অভিযোগের স্পর্শ নেই।
এসব অভিযোগের পেছনে এক গভীর প্রশ্ন মাথা তোলে—এই সমস্ত ত্রুটি ও অশান্তির পরে আপনি আসলে কী সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন? আপনি কি এসব কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছেন? যদি হ্যাঁ, তাহলে ইসলামী শরিয়ত আপনাকে সে অধিকার দিয়েছে। যাতে আপনি অযথা নিজের স্বল্প জীবনের শান্তি নষ্ট না করেন। আপনি চাইলে তালাক বা খুলার অধিকার ব্যবহার করে নতুন জীবন শুরু করতে পারেন।
তবে বাস্তবতা আশ্চর্যরকম ভিন্ন। অধিকাংশ দম্পতি এই বিচ্ছেদের পথে না গিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়। এর মানে তারা এখনো একে অপরের সঙ্গে বসবাসে আগ্রহী—প্রেম-ভালোবাসা যতই ফিকে হোক না কেন, সহাবস্থানে তারা একধরনের নিরাপত্তা ও প্রয়োজন অনুভব করে। এখানেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে—যেহেতু আপনি সম্পর্ক ছিন্ন করছেন না, বরং একসাথে থাকতেই চান, তবে অভিযোগে অভিযোগ না বাড়িয়ে, তা সমাধানে রূপান্তরিত করুন। কথা বলুন, কিন্তু অভিযোগের সুরে নয়—সমাধানের সন্ধানে প্রশ্ন করুন :
‘আমার সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?’
‘আমি কীভাবে আমার স্ত্রীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে পারি?’
‘আমি কীভাবে আমার স্বামীর সঙ্গে সুখী জীবন গড়তে পারি?’
এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র অভিযোগ থেকে আপনাকে মুক্ত করবে না, বরং সম্পর্ককে বাস্তব সমাধানের পথে নিয়ে যাবে। সময়-অসময়ে, উপলক্ষহীনভাবে অভিযোগ করার পরিণতি কেবল গিবত, হিংসা, অপবাদ, গালিগালাজ এবং ঘরোয়া অশান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাই প্রয়োজন আত্মসচেতনতা, আত্মবিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা। একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে বোঝা জরুরি—কার কোন দায়িত্ব কোথায়? কার কাছ থেকে কী প্রত্যাশিত? এই উপলব্ধি থেকেই আলোচনা শুরু হওয়া উচিত, বিশেষত সেই বিষয়গুলো থেকে যেগুলোর সংশ্লিষ্টতা স্ত্রীর ভূমিকায়, যেন সমাধানের পথ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়। আল্লাহ তাআলা সবার দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও প্রশান্তিময় করুন। আমিন।